Sunday, January 27, 2008

হাদীস সংকলনের ইতিহাস

অহীয়ে মাতলু এর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোরআন শরীফ জায়েদ ইবনে সাবেত (রা) প্রমুখ সুনির্দিষ্ট অহী লেখকদের সাহায্যে লিখিত করে রাখার ব্যবস্থা করা হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় ’অহীয়ে গায়েরে মাতলু’ দ্বারা প্রকাশিত হাদীস শরীফ লিখিত আকারে সংরতি করার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না । তাও কোরআন শরীফ লিখিত হত বিচ্ছিন্ন ভাবে খেজুরের পাতা, চামড়া, হাড় ও কাঠ প্রভৃতি জিনিসপত্রের ওপরে । স্বভাবতঃ কোরআনের ঐ সব বিচ্ছিন্ন লিখিত অংশগুলো একালের বাঁধানো বইপত্রের মত সুদৃঢ়ভাবে গুছিয়ে বাঁধাই করে রাখা সম্ভব হত না । ফলে ঐ একই সময়ে একই পদ্ধতিতে হাদীস লেখার কাজ শুরু করা হলে কোরআন ও হাদীসের লিখিত অংশগুলো পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করার বা মিশ্রিত হওয়ার আশঙ্কায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় হাদীস লিখে রাখার কাজকে সাধারণভাবে নিষেধ করে দিয়েছিলেন এবং হযরত ওমর (রা)-ও হাদীস লিখে রাখার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন । কিন্তু কোন কোন বিশেষ সাবধানী সাহাবীর ক্ষেত্রে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিষেধ কিছু পরিমাণ শিথিল করে দিয়েছিলেন এমন প্রমাণ দুর্লভ নয় ।

আবু হোরায়রা (রা) বলেছেন, ’এই সব হাদীস আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখে শুনেছিলাম ও লিখে রেখেছিলাম এবং তাঁকে শুনিয়েছিলাম । আবু হোরায়রা (রা) ছাড়াও আরো অনেক সাহাবী যেমন আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর (রা) ও হাদীস লিখে রাখতেন । আবু হোরায়রা (রা) বলেন, ‘আব্দুল্লাহ্ ইব্নে আমর (রা)-এর কাছে বেশী হাদীস থাকতে পারে, কারণ তিনি হাদীস লিখে রাখতেন, আমি হাদীস লেখায় বিশেষ তৎপর ছিলাম না ।’ আমর (রা) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুযোগ করল যে সে হজরতের কাছে যা শুনছে তা স্মরণ রাখতে পারছে না । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার ডান হাতের সাহায্য নিতে বললেন (অর্থাৎ লিখে রাখতে বললেন) । হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা) ও কিছু কিছু হাদীস সংকলন করেছিলেন ।

মোট কথা সাধারণভাবে এবং ব্যাপকভাবে হাদীস লিখে রাখার কোন ব্যবস্থা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় প্রচলিত ছিল না । এ প্রসঙ্গে সহী বুখারীর বিখ্যাত টীকাকার আলকাস্তালানী বলেন, সাধারণতঃ সাহাবী বা তাবেয়ী কেউ হাদীস লিখে রাখতেন না । তাঁরা পরস্পরকে মৌখিক ভাবে হাদীস শিক্ষা দিতেন এবং অক্ষরে অক্ষরে তা কণ্ঠস্থ করে রাখতেন ।’ একদিকে সেকালের আরবদের স্মরণশক্তি যেমন প্রখরতর ছিল, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অর জ্ঞানের অভাব তেমনি ভয়াবহভাবে ব্যাপকতর ছিল । কোরআনের সাথে হাদীসের সংমিশ্রন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার দ্বার রূদ্ভ করা এবং এই সব নিরক্ষর সাধারণ মানুষদের মধ্যে লেখার পরিবর্তে মৌখিক আকারেই হাদীসের প্রচার ও প্রসার সহজসাধ্য হবে ভেবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের কালে হাদীস লিখে রাখার কাজকে বিলম্বিত ও নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল ।

কিন্তু চলমান কাল একদিন হাদীস লিখে রাখার পথের সবচেয়ে বড় বাধাটা দুর করে দিল । খলীফা আবুবকর (রা) এর নির্দেশে সাহাবী জায়েদ ইবনে সাবেত (রা) কোরআন শরীফের যে পুর্ণাঙ্গ গ্রন্থটি সঙ্কলিত ও লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা) তার অসংখ্য কপি প্রস্তুত করিয়ে সারা সাম্রাজ্যের দিকে দিকে মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করলেন । ফলে কোআন শরীফের ব্যাপক প্রচার সাধিত হল । কোরআনের নির্ভুল পাঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অন্তরে অন্তরে নুরের আখরে মুদ্রিত হয়ে গেল । এখন আর কোরআনের মধ্যে হাদীসের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা রইল না । অন্যদিকে ইসলামী সাম্রাজ্যের ব্যাপাক প্রসার এবং অন্যান্য কারণজনিত ক্রমবর্ধমান জীবন-সমস্যার অস্বাভাবিক জটিলতার সমাধান পাওয়ার জন্য সমগ্র মুসলিম জগৎ পবিত্র হাদীস শরীফকে সঙ্কলিত আকারে পেতে একান্তভাবে উৎসুক হয়ে উঠল । কুফা, কায়রো, দামেস্ক প্রভৃতি লোকাকীর্ণ নগর গুলোর বিচার-কার্য পরিচালনার জন্য আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হল ।’ কিন্তু ‘প্রত্যাদেশের (অর্থাৎ কোরআনের) অপরিসর’ আয়তনের মধ্যে সেই ব্যাখ্যা সহজলভ্য হল না । তাই সমস্যা সমাধানের জন্য হাদীসের আশ্রয় গ্রহণের কামনা বিশ্ব মুসলিমের অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রবলতর হয়ে উঠল ।

খোলাফায়ের রাশেদিনের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে অজস্র জাল বা ‘মওজু’ হাদীস রচনায় লিপ্ত হওয়া, হাদীস শরীফকে লিখিত গ্রন্থের আকারে সংকলন ও সংরণ করার প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হয়ে উঠল । জাল হাদীসের জঞ্জালের তলায় আসল হাদীস প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসল । গোঁড়া সুন্নী,শিয়া, খারেজী, মুতাজেলা, জিন্দিকও সুফী সম্প্রদায়ের বহু ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তখন হাদীস প্রচার করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে । শিয়া মতাবলম্বীর একটি অংশ হযরত আলী (রা) বংশধরকেই খেলাফতের একমাত্র উত্তরাধিকারী বলে তাদের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিতান্ত উদ্দেশ্যমুলক ভাবে হাদীস উদ্ধৃত করতে শুরু করে । সুন্নী ও খারেজীরা ঠিক এর বিপরীত দাবীটাই বিভিন্ন হাদীস উদ্ধৃত করে প্রচার করতে শুরু করে । উদ্ধৃতিতে যেখানে আটছে না অত্যুৎসাহী অন্ধ সমর্থকেরা সেখানে মনের মত হাদীস নিয়ে নিজ নিজ বক্তব্যকে জোরদার করেছে । ওদিকে জিন্দিকরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে দ্বিত্ববাদী ন্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছে । তারা আল্লাহর রসুলের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে । অন্য দিকে গ্রীক বিজ্ঞান-দর্শনের ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত মুতাজেলা সম্প্রদায় ঈমানের মুলশর্ত অস্বীকার করে ধর্ম- বিশ্বাসকে প্রমাণ ও বিচার সাপেক্ষ করে’ তুলল । তারা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের মত মানবিক অবয়ব বিশিষ্ট রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে আকাশ ভেদ করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অসম্ভব বলে মনে করল এবং সেই যুক্তিতে ‘মে’রাজ’ বা ‘নভোভ্রমণ’কে অস্বীকার করল । তারা আল্লাহর সর্বময় একত্বের দোহাই দিয়ে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত পালন করাকে সম্পুর্ণরুপে বর্জন করল । সার্বিক পরিস্থিতির এই ঘোলাপানিতে মৎস্য-শিকারের উদ্দেশ্যে এক শ্রেণীর পোষকতাকারী খলীফাদের দরবারের জাকজমক ও বাহ্যাড়ম্বরকে সমর্থন করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুচরদের অনাড়ম্বর জীবনের পুণ্যসমুহ মুছে দিতে লাগলো । উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য তাঁরা নানান মিথ্যা ও কল্পিত কাহিনী প্রচার করতে লাগলো । এসব তথ্যের প্রমাণ স্বরূপ তাঁরা নানান কল্পিত হাদীস তুলে ধরতে লাগলো । ফলে অসংখ্য ‘মওজু’ বা জাল হাদীসের আবির্ভাবে মুসলিম জগতের ভাগ্যাকাশ দুর্যোগের কালোমেঘে ঘনঘোর হয়ে উঠল ।

কিন্তু মেঘের আঁধারের পেছনেই সূর্যের আলোক প্রতীক্ষা করে । তাই এবার হাদীসের সংঙ্কটের ঘন অন্ধকার ভেদ করে’ নতুন দিনের নতুন সূর্যালোক দিগন্ত রক্তিম করে জ্বলে উঠল । রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া এই সব মিথ্যা কথা বা জাল হাদীসের জঞ্জাল থেকে হাদীস-শাস্ত্রকে নিরাপদ ও নিষ্কণ্টক করার উদ্দেশ্যে এবং সমসাময়িক সুবিশাল মুসলিম-বিশ্বের বিচিত্র সমস্যার সমাধানকে হাদীসের মাধ্যমে সর্বত্র সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর ৮৯ বছর পরে হিজরী ৯৯ সনে উমাইয়া বংশের শ্রেষ্ঠ খলীফা ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ বা দ্বিতীয় ওমর হাদীস-সংকলনের কাজে উদ্যোগী হলেন । তিনি ছিলেন দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রা)-এর দৌহিত্রৈর পুত্র । আচারে ও আচরণে তিনি খলীফা ওমর (রা)-কেই অরে অরে অনুকরণ করতেন, তাই ইসলামের ইতিহাসে তিনি ‘দ্বিতীয় ওমর’ নামে বিখ্যাত । তিনি তাঁর-নিযুক্ত মদীনার গর্ভনর আবু বকর ইবনে হযমকে হাদীস সংকলনের কাজে অগ্রসর হবার জন্য আদেশ দিলেন । লিখলেন, ‘আমার আদেশ আপনি রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক একটা হাদীস তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করুন এবং লিখে রাখুন । আমার ভয় হচ্ছে, এরকম না করলে একদিন এ জ্ঞানভান্ডার বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই জ্ঞানভান্ডারের রক সাহাবী ও তাবেয়ীগণ দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন । (বুখারী শরীফ)

ফলে এই হিজরী প্রথম শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকেই হাদীস সমূহ গ্রন্থাকারে সংকলন করার ব্যাপক প্রয়াসের একটা বান ডেকে গেল । ঐতিহাসিক উইলিয়াম ময়ুর বলেন, ‘হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের প্রায় একশ বছর পরে খলীফা দ্বিতীয় ওমর প্রচলিত হাদীসগুলোকে সংগ্রহ ও সঙ্কলিত করার জন্য একটা বৃত্তাকার আদেশ দিলেন । এইভাবে যে কাজের সুত্রপাত হল, প্রবল বেগে তা অগ্রসর হতে লাগল ।আল্লাহর অনেক নেক বান্দারা এই হাদীস সংগ্রহ করার জন্যে তাঁদের ‘জীবন যৌবন ধন-মান’ সব কিছু উৎসর্গ করে দিলেন । আল্লাহ তায়ালা তাদের সকলকে উত্তম প্রতিদান দান করুন ।

No comments: